Monday, July 14, 2008

আমার সালসা শেখা...

সেই ৭ বছর বয়স থেকেই আমার জীবন মোটামুটি 'রোবোটিক'। ছোটবেলা থেকেই আমার বাবা মা আমাকে পড়াশোনার জন্য স্কুলের কোচিং এর পাশাপাশি নাচ আর গানের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। আর আরবি ক্লাস তো আছেই, তাই সপ্তাহের প্রায় প্রতিটা দিনই আমার কোনও না কোনও কিছুর ক্লাস লেগেই থাকত। এমনকি বাইরে খেলতে যাওয়ার দিনগুলিও ছিল আমার বাঁধাধরা। এখন বাবা মা কোনো কিছু কনট্রোল না করলেও 'রোবোটিক' জীবনের খুব একটা পরিবর্তন আসেনি, বরং এর সাথে যোগ হয়েছে 'স্ট্রেস'।


আমি ছোট থেকেই খুবই ফাঁকিবাজ ধরনের তাই সবসময়ই কোনো না কোনো ক্লাস ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করতাম। আরবি পড়ার জন্য বাসায় হুজুর আসতেন তাই সেটায় ফাকি দেয়ার কোনও উপায় ছিলনা। স্কুলের কোচিংয়েও ফাকি দেয়া যেতনা। তবে গানের ক্লাস, সফল না হলেও ফাকি দেয়ার চেষ্টা করতাম। যদিও গান আমি এখন অসম্ভব ভালবাসি, তখন একদমই যেতে চাইতাম না। গানের ক্লাসে না যাওয়ার জন্য প্রতি সপ্তাহে এক এক কারণ বের করতাম। যতটা সম্ভব কাঁদো-কাঁদো মুখ করে আম্মুর কাছে গিয়ে বলতাম "আম্মু আজকে হঠাৎ একটু আগেই দেখি খুব গলা ব্যথা", নয়ত পেট ব্যথা নয়ত অন্য কিছু। হঠাৎ কখনো কখনো সফল হলেও প্রায় সব সময় আম্মু ফাঁকিবাজি ধরে ফেলত আর ধমক দিয়ে পাঠাত। যখন সফল হোতাম তখন নিজেকে ভাবতাম ইসস আমি কত চালাক , কিন্তু এখন বুঝতে পারি আম্মু আসলে তখন ঠিকই বুঝতে পারতেন আর মায়া করেই বলত "ঠিক আছে আজ যেতে হবেনা"।


এরপর হোল আরেক বিপদ, আম্মু বাসায় এক গানের ওস্তাদ ঠিক করল। আমার মাথায় বাজ পরার মত অবস্থা। এক ক্লাস ফাকি দিতেই হিমশিম খাই আর এখন বাসায় এসে উপস্থিত ওস্তাদ কিভাবে ফাঁকি দেই! কি আর করা বাধ্য হয়ে তখন প্রতি সপ্তাহে ডাবল ডোজের গানের তালিম নিতে থাকি, আর যেদিন ওস্তাদ বিকেলে আসতেন সেদিন বাইরে খেলতে যাওয়ার ২-৩ দিনের মাঝ থেকে আরও একদিন কমে যেত, বিরক্তির সীমা থাকতনা।


কিন্তু নাচের ক্লাসের জন্য ছিল আমার দারুন উৎসাহ। ক্লাস ফাকি দেয়াতো দুরের কথা আমি দিন গুনতাম কবে মংগলবার আসবে। এমনিতেই তিরিং বিরিং ভাব, নাঁচুনি বুড়ি, তার উপর ঢোলের বাড়ি,বাসায় এসেও আমার নাচ থামত না। বাসায় কেউ বেড়াতে আসলেই তাকে দেখাতাম নতুন কি শিখলাম। যেখানে বকা না দিয়ে আমাকে হারমোনিয়াম নিয়ে বসানো যেত না সেখানে নাচের কথা আমাকে বলতেও হোতনা, সারাদিনই প্রাকটিস।


যদিও গানই এখন পর্যন্ত ধরে রেখেছি, নাচ আমার অসম্ভব প্রিয়। সিডনি এসে ছোটবেলায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নেচেছি যা সব ভিডিও ক্যাসেটে বন্দী হয়ে পরে আছে। এখানকার কিছু নৃত্যশিল্পী আন্টিরা শিখিয়ে দিত আর সেই রিহার্সালের মজার দিনগুলির কথা মনে পরলে অজান্তেই মুখে হাসি ফোটে। এখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অভাব নেই, কিছুদিন পর পর কিছুনা কিছু লেগেই থাকে। শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের একাধিক অনুষ্ঠান ছাড়াও এসোসিয়েশন এর ফাংশন, বাংলা স্কুলের ফাংশন আরও কত কিছু। আম্মুর শখ ছিল তার মেয়েকে ফাংশনে নাচতে দেখা, আম্মুর সেই শখ মিটলেও আমার নাচ শেখার শখ মিটল না। খুব আফসোস হয়, দেশে থাকলে হয়ত নাচটা চালিয়ে যেতে পারতাম। হয়ত এতদিনে আমাকে টিভিতে সাইড নৃত্যশিল্পী হিসেবে টুকটাক দেখতেও পারতেন। দেশে যে হারে টিভির চ্যানেল বেরিয়েছে কয়েক ঝলকের জন্য হলেও হয়ত কোনো না কোনোটায় নিশ্চই একবার হলেও চান্স পেতাম।


গত বছর আমি আর আমার এক বান্ধবী ঠিক করলাম আমরা সালসা শিখব। যত বিজ্ঞাপন দেখলাম সব গুলোতে বলত নিজের ছেলে সঙ্গী নিয়ে আসতে হবে। যখন একটায় দেখলাম ছেলে সঙ্গী লাগবেনা তখন আমরাতো দারুণ খুশি, সাথে সাথে ভর্তি হয়ে গেলাম।


প্রথম দিন ক্লাসে গেলাম, নাচের ইন্সট্রাকটর দেখলাম বেশ ভাল। সবাইকে লাইনে দাড় করিয়ে এক এক করে স্টেপস শেখাতে লাগল। ক্লাসে খেয়াল করে দেখলাম আমাদেরই সবচেয়ে বয়স কম, বেশির ভাগই ৫০ উর্ধে মানে বাবা/মা/আঙ্কেল/আন্টি এমন কি দাদা/নানি টাইপের বয়সেরও ছিল। আমার বান্ধবী বলে যে সিটির বাইরের শহরে এই সময় এমন বয়সের লোকজন থাকাই স্বাভাবিক। আমরা ভাবলাম তাতে কি আমরাতো নাচই শিখতে এসেছি, ক্লাসে কে আছে না আছে তাতে কি আসে যায়, অবশ্য সুন্দর দেখতে কেউ থাকলে আপত্তি করতাম না ।


যাইহোক আমি আর আমার বান্ধবীতো মহা খুশিতে শিখতে লাগলাম, আমি না পারলে ও দেখিয়ে দিচ্ছে আর ও না পারলে আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। এমন সময় নাচের ইনসট্রাকটর বলল সব ছেলেদের গোল হয়ে দাঁড়াতে, আর মেয়েদের বলল ঘুরে ঘুরে এক এক ছেলের সাথে নাচতে। শুনেতো আমি আর আমার বান্ধবী দুজন দুজনের দিকে তাকাচ্ছি। কম বয়সী সুন্দর কারো সাথে নাচতে হলে অন্য ব্যাপার কিন্তু এই বিশাল বয়স্ক ভুরিঅলাদের সাথে নাচতে হবে শুনেই আমার ... । তখন আমার ছোটবেলায় আম্মুকে গানের স্কুল ফাকি দেয়ার এক্সকিউস গুলো মনে পরল। আমি ইনসট্রাকটরকে খুব পেট ব্যথার কথা বলে চেয়ারে গিয়ে বসলাম। নাচের মাঝে মাঝে উনি আমার দিকে তাকাতেই একটু আধটু পেট ব্যথার ভান করার চেস্টা করলাম। বাসায় ফেরার পথে আমি আর আমার বান্ধবী হাসতে হাসতে গড়াগড়ি অবস্থা, এই তাহলে ছেলে সঙ্গী না লাগার কারন। আমি বললাম পুরো $১২০ ডলার পানিতে গেলেও আমার আপাতত সালসা সেখার সখ মিটেগেছে, এটলিস্ট নিজের পার্টনার না পাওয়া পর্যন্ত ...।

No comments: